আজব ভালবাসা
511
বার পঠিতবিদ্যুৎ নেই। গরমে একটু
শান্তি পেতে ছাদে এসে ঠান্ডা বাতাসে বসে কানে হেডফোন
লাগিয়ে তাহসানের গান শুনছি। হঠাৎ গান
থেমে ফোনটা বেরসিক সুরে বেজে উঠল।
- হ্যালো। কেমন আছো।
- ভাল। তুমি?(আমি)
- ভালই আছি। ফোন দাওনা কেন এখন?
- আমার সাথে কথা বলার সময় আছে তোমার?
- দেখ, ফালতু কথা বলবানা।
- আচ্ছা।
- কয়েকদিনের জন্য বাসায় এসেছি।
- হুমম। কেন?
- হুমম কেন মানে? খুশি হওনি?
- না, ব্যাপারটা সেরকম না। আসলে অনেক ব্যস্ত তো তুমি।
তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
- আচ্ছা বাদ দাও। শোন, আগামীকাল সকাল ১১ টাই
বেইলি রোডের কে.এফ.সিতে এসে দেখা করবা। এখন রাখি।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন কেটে দিল
জান্নাত। মেয়েটার সাথে নামে মাত্র
সম্পর্কটা টিকে আছে। ভাবতে অবাক লাগে আগে এই মেয়ের
সাথেই ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা বলতাম। আর এখন কথা ২
মিনিটও গড়ায় না। অনুভূতিগুলো হয়ত ভোতা হয়ে গেছে।
আমি বাধন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত সম্মান ৪র্থ বর্ষ।
এবং জান্নাত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এম.বি.বি.এস ২য়
বর্ষে পড়াশোনা করছে। ৪ বছরের সম্পর্ক আমাদের।
অনেকটা স্বপ্নের মতই ওর সাথে সম্পর্কটা হয়ে যায় আমার।
আজ তা মাত্রই স্বপ্নবিলাশ। ভাবলেও হাসি পায়। আজ
২টা টিউশনির টাকা পেয়ে অনেক ভাল লাগছিল। কিন্তু
জান্নাতের সাথে দেখা করতে গেলে আমার পূর্ণ মানিব্যাগ
রিক্ত করে বাড়ি ফিরতে হবে ভেবে কিঞ্চিত মন খারাপ হল।
মন খারাপ ভুলতে আবার গানে মনোযোগ দিলাম।
রাতে খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম
থেকে উঠে গুছিয়ে বের হলাম জান্নাতের
সাথে দেখা করতে। রাস্তায় বের হয়ে রিক্সা খুজছিলাম।
তখন মানিব্যাগের কথা মনে পড়ায়
হাটতে হাটতে সেগুনবাগিচা থেকে বেইলি রোডে যাচ্ছিলাম।
মাঝখানে একবার ফোন দিয়ে জানাল যে সে পৌছে গেছে।
এখন কর্তব্যস্বরুপ আমাকেও তাড়াতাড়ি পৌছানো উচিত।
কাকরাইলে আসতেই দেখি একটা জায়গায় মানুষের জটলা।
ভীড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখি একটা ৮-৯ বছরের
বাচ্চা ছেলে এক্সিডেন্ট করে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
আর তার মা একটু সাহায্যের জন্য সকলের কাছে অনুরোধ
করছে। কিন্তু কেও তাকে সাহায্য করছেনা। শেষে আমিই
তাকে আর
বাচ্চাটাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করলাম।
ডাক্তার বলল অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। এখনি ও পজেটিভ রক্ত
লাগবে। আমার একই গ্রুপ হওয়ায় আমি রক্ত দিলাম। সন্ধ্যার
দিকে ডাক্তার বলল, পা ভেঙ্গেছে আর অন্যান্য কিছু
সমস্যা। বাচ্চাটা এখন আশঙ্কামুক্ত কিন্তু
হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে বেশ কিছুদিন। ঘুম
পাড়িয়ে রাখা হয়েছে এখন। তাই বাচ্চাটার
সাথে দেখা না করেই চলে আসলাম। এতকিছু
করলাম,তবে বাচ্চাটার মা চোখের
পানি ফেলা ছাড়া একবারও কথা বললনা। আমি ভাবলাম হয়ত
অনেক শকড তাই কিছু বলছেনা। বাসায়
ফিরলে রক্তমাখা জামা দেখেই আম্মু জেরা শুরু করে দিল।
পুরো ঘটনা বললাম। সারাদিনের চাপে জান্নাতের
কথা ভুলেই গেছিলাম। ফোন বের করে দেখি ৩২ মিসডকল।
ফোন ব্যাক করলাম। ৮-৯ বার রিং হওয়ার পর
ধরে আমাকে স্বার্থপর,কিপটা,কেয়ারলেস
ইত্যাদি ইত্যাদি বলল। আর বলল কনোদিন যেন যোগাযোগ
না করি। এবারও উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন কেটে দিল।
এমনভাবে কথা বলল যেন ও এই সুযোগটারই অপেক্ষা করছিল।
আসলে আমিও আর পারছিলামনা। দুঃখ তেমন পেলাম না।
মোমবাতিকে ঝড়ের ভেতর আর কতক্ষন আগলে রাখব!
যে যেতে চাই, তাকে আটকে রেখে কি লাভ! যাও জান্নাত,
তোমাকে মুক্ত করে দিলাম।
পরদিন সকালেই গেলাম বাচ্চাটার সাথে দেখা করতে।
গতকালের চাপ এখনো চোখেমুখে স্পষ্ট তার। আমি যেতেই
তার মা যায়গা ছেড়ে বাইরে চলে গেল।
আমি হালকা কথা বলে ভার্সিটিতে চলে গেলাম।
এভাবে প্রতিদিনই আমি বাচ্চাটার
সাথে দেখা করতে যেতাম। আস্তে আস্তে বাচ্চাটাও
আমাকে পছন্দ করা শুরু করল। জানলাম ওর নাম সজীব। ও
আমাকে মামা বলে ডাকত। আস্তে আস্তে ওর মাও আমার
সাথে কথা বলা শুরু করল। ঐদিনের সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ
জানালো। আমি প্রতিদিন যাওয়ার সময় সজীবের জন্য
ফল,চিপ্স,চকোলেট নিয়ে যেতাম। ওর মাও
বাসা থেকে খাবার রান্না করে আনত এবং আমাদের
দুইজনকেই জোর করে খাওয়াত। প্রায় ২০ দিনের
টানা সম্পর্কে আমি তাকে বোন বলে ডাকতাম আর আমার
কোনো বোন না থাকায় তাকে আমি নিজের বোনের মতই
মনে করতাম আর সে আমাকে ভাই বলে ডাকত। তবে সজীবের
বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলেই কথাটা কেমন
জানি এড়িয়ে যেত। দেখতে দেখতে আরও কিছুদিন চলে গেল।
আসলে মানুষের সুখসময় বেশিদিন থাকেনা। সজীবের
ডিসচার্জের দিন চলে আসল। সজীবের খুব মন খারাপ ছিল।
কারণ রোজ আমার সাথে দেখা হবেনা। চিপ্স, চকোলেটও
কেউ কিনে দিবে না। ডিসচার্জের দিন
হাসপাতালে গিয়ে দেখি সজীবের অলরেডী ডিসচার্জড
হয়ে গেছে। মনটা খুব খারাপ হল এই
ভেবে যে আমাকে না জানিয়েই চলে গেল। ঠিকানা,ফোন
নাম্বার কিছুই জানতামনা। তাই যোগাযোগ
করতে পারলামনা। আপুর উপর কিছুটা রাগও হল।
মাস তিনেক পর টিউশনির পর বাড়ি যাচ্ছি হঠাৎ সজীবের
সাথে দেখা। আমাকে দেখে খুব খুশি হল সে। পরক্ষনেই আবার
মনমরা হয়ে গেল। আমি সেভাবে খেয়াল
না করে তাকে সবকিছু জিজ্ঞাসা করলাম। চিপ্স,চকোলেট
কিনে দিলাম। তারপর তাদের বাসায় যেতে চাইলাম।
প্রথমে একটু গাইগুই করলেও আমাকে নিয়ে গেল সে।
গিয়ে আমি যা দেখলাম তাতে নিজের চোখকেও বিশ্বাস
করতে পারছিলামনা। ঘটনাটা এইরকম হবে কখনও চিন্তাও
করতে পারিনি। কোনোরকমে সজীবকে শুধু বাসায়
যেতে বললাম। সন্ধ্যার পর আমি তাদের বাসায় গেলাম।
আমাকে দেখে চিনতে পেরে তার মা আমার থেকে মুখ
লুকালো। আমাকে চলে যেতে বলল। আমি তাকে কিছু
বুঝাতে গেলেও সে বোঝেনা। আমাকে একরকম বের
করে দিল। কিন্তু আমি প্রতিদিনই যেতাম শুধু আপুর সাথে একটু
কথা বলার আশায়। কিছুদিন পর সে আমার
সাথে কথা বলতে রাজি হল। সে বলল, ডিসচার্জের দিন
আমাকে না জানিয়ে চলে আসা, প্রথমে আমার
সাথে কথা না বলার কারণ হল তার এই সামাজিক অবস্থা,
তার পেশা, লোকে যাকে ভদ্র ভাষায় বলে “পতিতাবৃত্তি”।
ব্যাপারটা কেন জানি মন থেকে মেনে নিতে পারছিলামনা,
তবে নিজেই নিজেকে বুঝালাম এরকম অবস্থায় কেউ
ইচ্ছা করে আসেনা, আসে অন্য কারো পৈচাশিক প্রবৃত্তির
জন্য। তারপর আমি আপুকে অনেক বুঝালাম।
তবে সে বুঝতে নারাজ। যা-ই বলি না কেন। তার শুধু একটাই
কথা, সেটা হল আমি যেন তার সাথে আর দেখা না করি।
কারণ এতে আমার সম্মানহানি হতে পারে। কিন্তু
আমি প্রায়ই যেতাম আপু আর সজীবের সাথে দেখা করতে।
তারপর হঠাৎ একদিন আপু আর সজীব কোথায় যেন
হারিয়ে গেল। নিজেকে মাফ করতে পারছিলামনা। কারণ
তাদের এখান থেকে চলে যাওয়ার একমাত্র কারণ আমি।
তবে যাওয়ার সময় আপু আমার জন্য
একটা চিঠি লিখে রেখে গেছেন। এটাই যা আশার বানী।
চিঠি খুলেই পেলাম আমার সেই কাঙ্খিত প্রশ্নের উত্তর। কেন
সে আজ এখানে। আপু যা লিখেছিলেন তার সারসংক্ষেপ হল,
অল্পবয়সে ভালবাসার তাড়নায় এক নরপশুর ক্ষুধার্থ
কবলে পড়ে আজ সে এই পরিস্থিতির সম্মুক্ষীন।
হাইরে ভালবাসা! যার কারনে আমি একাকিত্ত্বে ভুগি,
আমার এই বোনের মত হাজারো মেয়ের জীবন নষ্ট হয় আবার
কত মানুষ এই ভালবাসার কারনেই সুখোদ্দ্যমে ছোটে।
প্রথমে আপুর এই অবস্থার জন্য কেমন লাগলেও মনকে বুঝালাম
এতে তার তো কোনো দোষ নেই। ভালবাসা তো দোষ না।
আমি তাকে বোনের মত ভালবাসি, সেও আমাকে ভাই এর মত
ভালবাসে কিমবা বাসত কিমবা আদৌ না। ব্যাপার না।
আমি তো বাসতাম। এরপর আমি ওখানে গেলে তাদেরকে আর
কখনো খুজে পাইনি। আসলেই মানুষের জীবনে সুখ
স্থায়ী হয়না। জীবন থেকে হারালাম একজন বোনকে, একজন
ভাগনেকে । হারালাম শুধু একটা নরপশুর পৈচাশিক কাজের
জন্য। না থাক রক্তের সম্পর্ক, তবে সে সম্পর্কের
প্রকটতা রক্তের সম্পর্কের চেয়ে কিঞ্চিত বেশিই ছিল।
আসলে পতিতা শব্দটার কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই। রাতের
আধারে কিমবা দিনের
আড়ালে যারা তাদেরকে পতিতা বানায়, সমাজ সেই
পুরুষদেরকে ঘৃণার চোখে দেখেনা। দেখে শুধু
পতিতারূপী মেয়েদের। তবে যতই বোন বলিনা কেন,
সামাজিকভাবে কখনই তাকে বোন হিসেবে স্বীকৃতি হয়ত
দিতে পারতামনা। কারন এই পতিতারাই যাদের অবসর
আনন্দের খোরাক যোগায়। তারাই এই পতিতাদের
অগোচরে বা সামনে কাপুরুষ হতে ভদ্রমুখোষ
পরে এসে তাদেরই বিরুদ্ধাচারণ করে।
পুরুষরূপী কাপুরুষগুলো এই সুযোগ ব্যবহার করে তাদের
ক্ষুৎপিপাসা মিটায় আর ফল ভোগ করে নিরীহ মেয়েগুলো।
মিথ্যা ভালবাসার কারনে সত্য ভালবাসা হয়ে যায় ফিকে।
এভাবে হারিয়ে যায় একটি ভাই-বোনের ভালবাসা, মামা-
ভাগ্নের ভালবাসা। তবুও বন্ধ হয়না এই প্রথা। লজ্জা হয়না ঐ
নরপশুদের। মুল্যহীন হয়ে পড়ে ভালবাসা। হাইরে ভালবাসা!
তুমি আসলেই বড় আজব।
ডন মাইকেল কর্লিওনি বলছেনঃ
ফাতেমা জোহরা বলছেনঃ
ভালো লাগলো।