একজন রেহানা কিংবা কিছু মিথ্যাচারের গল্প…
530
বার পঠিতচুলায় ভাত বসিয়েছিল আসমানী, হঠাৎ কোথেক্কে “মিলিটারি মিলিটারি” চিৎকার করতে করতে ছুটে এল নশু পাগলা। জীপ তিনটা গ্রামে ঢুকলো ঠিক তখনই, কিছুদূর গিয়ে থামতেই লাফ দিয়ে পাকিস্তানী শূয়োরগুলো নামলো। আসমানীর স্বামীর খোঁজে পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলো, না পেয়ে অগত্যা আসমানী আর তার ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধা শাশুড়ির পেটে ইসলামের নামে পাকিস্তানের বীজ বুনে যাওয়াই মনস্থির করলো। কয়েকদিন আগে রেহানা নামের ফুটফুটে একটা পরী জন্ম দেওয়া আসমানি অবশ্য এই পবিত্র পৈশাচিকতা সহ্য করতে পারলো না, “মাগো, মাগো বলে কয়েকবার আর্তচিৎকারের পর নিস্তেজ হয়ে গেল। যোনির ভেতর বেয়নেট নিয়ে নির্বিচারে খোঁচানোয় গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগলো। যাবার সময় হঠাৎ বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা রেহানার দিকে চোখ পড়লো ওদের, “সালে মালাউন বি বাচ্চে, কিমা বানাও উসকো”… কমান্ডারের অর্ডার পেয়ে আর দেরী করল না শুয়োরগুলো, ২৫ দিন বয়সী ফুটফুটে পুতুলটাকে সজোরে আছাড় মারলো মাটিতে, তারপর প্রবল আক্রোশে বুট দিয়ে পিষতে লাগলো ছোট্ট শরীরটা, সবাই মিলে…
ঠিক তার একদিন পর ট্রেনিং শেষে বিদায় নেবার জন্য বাড়ি ফিরলো অহিদুল্লাহ, উঠোনে পড়ে থাকা একতাল মাংসপিণ্ডকে প্রথমে সে চিনতে পারেনি, তারপর চাপ চাপ রক্তের ভেতর মেয়ের গায়ের হলুদ জামাটা দেখে সে যেন কাঁদতেও ভুলে গেল। ক্ষতবিক্ষত স্ত্রী আসমানী বা ছিন্নভিন্ন বৃদ্ধা মা নয়, অহিদুল্লাহ নির্বাক হয়ে গেল রক্তে ভেজা হলুদ জামাটা দেখে, একতাল মাংসপিন্ডে পরিনত হওয়া তার ছোট্ট পুতুলটাকে দেখে…
সরফরাজ খানের হাই ব্লাড প্রেশার, স্ট্রোক হয়েছে দুবার, যেকোনো ধরনের উত্তেজনা থেকে তাকে দূরে থাকতে বলেছে ডাক্তার।কিন্তু সরফরাজ আজ নিজেকে সামলাতে পারছেন না। আর মাত্র ১৬ রান লাগে, ওই কালো বেঁটে মছুয়া বাঙ্গালীগুলোকে হারাতে, কিন্তু ইংল্যান্ডের হাতে আছে মাত্র দুই উইকেট। শালারা নাকি ক্রিকেটের জন্মদাতা, লজ্জা হওয়া উচিত ধইঞ্চাগুলার, নোংরা অপদার্থ বাঙ্গালগুলার কাছে বিশ্বকাপের মত একটা জায়গায় হেরে যাইতেছে… চিন্তার জালটা হঠাৎ ছিঁড়ে গেল সরফরাজের, ১৪৫ কিলোমিটার বেগের ফুল অ্যান্ড স্ত্রেট একটা গোলায় ব্রডের স্ট্যাম্প ভেঙ্গে ছত্রখান হয়ে গেল, টগবগে ঘৃণা ফুটতে থাকা সরফরাজের মুখটা দেখে মনে হল, কেউ সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিয়েছে। এক বল পর যখন রুবেল অ্যান্ডারসনের স্ট্যাম্প বাতাসে উড়িয়ে বাঘের গর্জনে ছুটতে থাকলো, পাকিস্তান আর্মির অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সরফরাজ খান দুহাতে মুখ ঢেকে ধপ করে বসে পড়লো সোফায়, চকিতে চোখের সামনে ভেসে উঠলো ৪৪ বছরের পুরনো এক দৃশ্য…
সেদিন গ্রামটা জ্বালিয়ে দিয়ে ফিরছিল ওরা, জবাইয়ের পর হাতে লেগে থাকা তাজা রক্ত শুকোয়নি তখনো। মনটা বেশ খুশি খুশি লেঃ সরফরাজের, এক মুক্তির বাড়িতে তাকে না পেয়ে সব লুটপাট করেছে গনিমতের মাল হিসেবে, তারপর তার বউ আর মাকে ছিঁড়েখুড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে, বাচ্চাটাকে আছাড় দিয়ে বুট দিয়ে পিষে ভর্তা বানিয়ে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে এসেছে। শালা মালাউনের বাচ্চারা, ভারতের দালালী কইরা পাকিস্তান ভাঙতে চায়, এইগুলারে ঝাড়ে বংশে নির্মূল না করতে হয়। ভাবতে ভাবতে প্রসন্নের হাসি ফুটে উঠে সরফরাজের মুখে। হঠাৎ যেন কেয়ামত শুরু হল। চারপাশ থেকে প্রচণ্ড গুলি, কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুটো শুয়োর পড়ে গেল। সরফরাজের জোর কপাল, গুলির শব্দে পাশের গ্রাম থেকে আরেকটা দল ছুটে এল ব্যাকআপ দিতে।সম্মিলিত পাল্টা আক্রমনের মুখে টিকতে পারলো না,গুলি করতে করতে বীর বিক্রমে প্রান দিল একে একে সবাই,শুধু একজন ছাড়া…
১৫-১৬ বছর বয়স হবে, বামদিকে ঝোপের পাশে কড়ই গাছের আড়ালে পজিশন নিয়ে ছিল, মেশিনগানের গুলির প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়লো খোলা জায়গাটায়,পেট আর কোমর রক্তে ভেসে যাচ্ছে, মারা যাচ্ছে ছেলেটা। অবাক হয়ে সরফরাজ দেখলো, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ছেলেটা থামছে না, বুকে হেঁটে গড়িয়ে গড়িয়ে এগোচ্ছে, লক্ষ্য কয়েকহাত দূরের স্টেনটা। মজা পেল সরফরাজ, গুলি থামাতে বললো সবাইকে, সাপের বাচ্চাটা কি করে দেখার খুব ইচ্ছে… গাঢ় একটা রক্তের স্রোত পেছনে রেখে পলকের মধ্যে স্টেনটা তুলে নিয়েই ফায়ার করলো ছেলেটা, ৩৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সিপাহী বক্তিয়ারের অসম্ভব তীক্ষ্ণ রিফ্লেক্স অ্যাকশনের জন্য এ যাত্রায় বেঁচে গেল ওরা, রাইফেলের এক ঝাঁক বুলেট থামিয়ে দিল ছেলেটাকে, কিন্তু তার আগেই স্টেন থেকে বেরনো গুলিগুলো বাম হাতটা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে সরফরাজের, ভয়ে কাগজের মত শাদা হয়ে গেছে সরফরাজের পরিহাসরত মুখটা…
না ,সরফরাজ স্টেনগানের আচমকা গুলিতে ভয়ে জমে যায়নি, ও ভয় পেয়েছিল ছেলেটার চোখগুলো দেখে। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে যেন উত্তপ্ত লাভাস্রোত বেরিয়ে আসছে ওই চোখগুলো থেকে, পুড়িয়ে দিচ্ছে, অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে সরফরাজ… ওই মরা চোখের অগ্ন্যূৎপাতের সামনে ও অসম্ভব ভয় পেয়েছিল সেদিন, ভয়টা আবার ফিরে এল ৪৪ বছর পর।ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপের কোয়াটার ফাইনালে ওঠা বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মরতুজা যখন আটবার অপারেশন হওয়া হাঁটুতে জমে যাওয়া পানিটা সিরিঞ্জ দিয়ে বের করে ধীরপায়ে এগিয়ে এলেন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে, চমকে উঠলো সরফরাজ। ক্যাপ্টেন ছেলেটার মাথায় একটা লালসবুজ পতাকা, স্পষ্টগলায় উচ্চারন করছে, উই ডেডিকেট দিজ ভিক্টোরি টু দ্যা ফ্রিডম ফাইটার অফ আওয়ার লিবারেশন ওয়ার… অসম্ভব ভীত দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়ে আবিস্কার করলো সে, ৪৪ বছর আগের সেই ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে, মাশরাফির মাথায় বাঁধা লাল-সবুজ পতাকায় ভেসে উঠেছে ছেলেটার সেই মুখ, চোখ থেকে বেরিয়ে আসছে সেই পুরনো লাভাস্রোত… পুড়ে যাচ্ছে সরফরাজ, অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে দ্রোহের পুরনো দংশনে…
ঠিক সে মুহূর্তে বহুদূরে, সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দুই তলায় গ্লাসের ভেতর সাজিয়ে রাখা রেহানা নামের একটা বাচ্চা মেয়ের পরনের হলুদ জামার সামনে দাড়িয়ে এক বৃদ্ধ তার ১৩ বছর বয়সী নাতির প্রশ্নের জবাবে বললো, নাহ নানাভাই, এগুলো সব মিথ্যা কথা। ৭১রে কোন যুদ্ধটুদ্ধ হয় নাই, সামান্য গণ্ডগোল হইছিল ইন্ডিয়ার দালালদের সাথে পাকিস্তানী আর্মির… আর একটা বাচ্চাকে কি বুটের নিচে পিষে মারতে পারে কেউ? পাকিস্তানী সেনারাও তো মানুষ ছিল, তাই না? এগুলো সব ভারতের চক্রান্ত, ডাহা মিথ্যাকথা… এইসব মিথ্যা কথায় কান দিবা না, ঠিক আছে?
হলুদ জামাটার সামনে স্তব্ধ মহাকাল নির্বাক লজ্জায় মাথা করে রইল কেবল… মানুষের নিকৃষ্টতায় সে আজ বড়ই বিব্রত…
missed several doses of synthroid
ইকবাল মাহমুদ অনিক বলছেনঃ can you tan after accutane
আবারো অসাধারন একটা লেখা পড়লাম
ডন মাইকেল কর্লিওনি বলছেনঃ
লিখতে প্রচণ্ড কষ্ট হইছে ভাই, প্রচণ্ড…
কৃষ্ণ গহ্বর বলছেনঃ metformin tablet
সত্যিই অসাধারন এক লেখা।
ডন মাইকেল কর্লিওনি বলছেনঃ
লাল সবুজের ফেরিওয়ালা বলছেনঃ
ডন ভাই এর লেখা আর আয়োজন করে কাঁদা একই রকম।কারন লেখা গুলা পরে কখন যে চোখ ভিজে উঠে বুঝতে পারি না
ডন মাইকেল কর্লিওনি বলছেনঃ
রাশেদুজ্জামান বলছেনঃ
এই লেখাটা আমাকে বেশ কিছুদিনের জন্য অথর্ব করে ফেলেছিল।
পড়ে রিভার্স এঙ্গেলে গিয়ে শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করতে হয়েছে এবং এই গল্পটা আমি অনেককেই শুনিয়েছি।
পড়ে রাজশাহীর কম্যুনিটি রেডিও ‘রেডিও পদ্মা’র ৪০০০০ শ্রোতা গল্পের হাট নামক একটা প্রোগ্রামে এই গল্পটা শুনেছে এবং এই বছর গল্পের হাট-৩ নামক বইয়ে গল্পটা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে…!
ডন মাইকেল কর্লিওনি বলছেনঃ
অসংখ্য অশেষ কৃতজ্ঞতা জানবেন