ত্রিশোত্তর বাঙলা কবিতায় কলাকৈবল্যবাদ, অস্তিত্ববাদ ও তিন দ্রোহি কবি [পর্ব -৩]
477
বার পঠিত missed several doses of synthroidতৃতীয় দ্রোহি : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
(ইতোমধ্যে ১ম ও ২য় পর্ব পোস্ট দেয়া হয়েছে)
আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি ?
কেন মুখ গুঁজে আছো তবে মিছে ছলে ?
কোথায় লুকাবে ? ধূ-ধূ করে মরুভূমি ;
ক্ষ’য়ে-ক্ষ’য়ে ছায়া ম’রে গেছে পদতলে ।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই ;
নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ ।
নিষাদের মন মায়ামৃগে ম’জে নেই ;
তুমি বিনা তার সমূহ সর্বনাশ ।
কোথায় পলাবে ? ছুটবে বা আর কত ?
উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা ।
প্রাকপুরাণিক বাল্যবন্ধু যত
বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা ।।
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে ?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া ।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে ?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া ।
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও ;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনো বিপদ্প্রাজ্ঞ নও ।
নব সংসার পাতি গে আবার চলো
যে-কোনও নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে ।
মিলবে সেখানে অনন্ত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে ।।
কল্পলতার বেড়ার আড়ালে সেথা
গ’ড়ে তুলবো না লোহার চিড়িয়াখানা ;
ডেকে আনবো না হাজার হাজার ক্রেতা
ছাঁটতে তোমার অনাবশ্যক ডানা ।
ভূমিতে ছড়ালে অকারী পালকগুলি,
শ্রমণশোভন বীজন বানাবো তাতে ;
উধাও তারার উড্ডীন পদধূলি ।
পুঙ্খে পুঙ্খে খুঁজব না অমারাতে ।
তোমার নিবিদে বাজাব না ঝুমঝুমি,
নির্বোধ লোভে যাবে না ভাবনা মিশে ;
সে-পাড়াজুড়ানো বুলবুলি নও তুমি
বর্গীর ধান খায় যে ঊন্তিরিশে ।।
আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দু-জনে সমান অংশীদার
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার ।
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি ।
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে ?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি ।
ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে ।
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক’রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি :
তুমি নিয়ে চল আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে বন্ধু আমি লোকায়তে বাঁধি । nolvadex and clomid prices
এ লোকায়তে কবিই সুধীন্দ্রনাথ। ত্রিশোত্তর কবি হিসেবে পরিচিত জীবনানন্দ, অমিয় চক্রবর্তী ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পাশ্চাত্য অনুসঙ্গে বাংলা ভাষায় কলাকৈবল্যবাদি কবিতা রচনা করে নিজস্ব অস্তিত্বকে করেছেন অনুরণিত। ঐ কালপর্বে গণজাগরণের ঐক্যে বিভেদের ফলে সামাজিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে; সমাজসচেতন কবিরা আশ্রয় গ্রহণ করেন রোমান্টিক স্বপ্নলোকে। যতীন্ত্রনাথ সেনগুপ্ত তাঁর ২য় পর্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে ওঠেন গভীর দু:খবাদি। আর তাই সামাজিক বাস্তবতার পর, অস্তিত্ববাদি ধারায় কাব্যরচনা করেন জীবনান্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬), সুধীন্দ্রনাথ দ্দ (১৯০১-১৯৬০), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) এবং বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮১) প্রমুখ কবিরা। ভারতের ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের যুগে, হতাশা ও অনৈক্যের সময় এ কবিরা তাঁদের আদর্শ খুঁজে পান, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী (১৯১৯-১৯৩৩) ইউরোপের আত্মাবাদি কবিদের মাঝে। ইউরোপিয় কবিদের ধারা অনুসরণ করে, অস্তিত্ব সংকটের ও মনোবেদনার চিত্র অঙ্কন করেন তাঁরা এক নতুন অর্ক্টেস্ট্রায়।
সবচেয়ে জটিল কবি হিসেবে পরিচিত বিংশ শতাব্দির সমবয়সি কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সমসাময়িক মনীষা দিয়ে সর্বাধিক প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে ম্যাক্স প্লাঙ্ক, আইনস্টাইন, ম্যারি কুরি, ফ্রয়েড, কার্ল গুস্তাভ জুং, বেনেদেত্তো ক্রোচে প্রমুখ; সাহিত্য চিন্তাকে উদ্বোধিত করেছে বার্নার্ড শ, লরেন্স, লুইস, ফকনার, এলিয়ট, ইয়েটস আর সবচেয়ে বেশি প্রতিধ্বনি শোনা যায় ফরাসি প্রতিবাদি মালার্মে আর ভারলেনের। ইউরোপ থেকে প্রত্যাবর্তনের (১৯২৯) পর সবচেয়ে সৃৃষ্টিশীল অধ্যায়ে রচিত ত্রয়ীকাব্যে রূপায়ণ ঘটে বিশ শতকি বোধের। অর্কেস্ট্রা (রচনা : ১৯২৯-১৯৩৩), ক্রন্দসী (রচনা : ১৯২৭-১৯৩৪) এবং উত্তর ফাল্গুনীর (রচনা : ১৯৩২-১৯৩৭) প্রেম, মৃত্যু ও ঈশ্বরচেতনায় নতুন আদর্শ স্থাপন করেছেন কবি।
অচরিতার্থ প্রেমের পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ একা একা দীপ্তগিতে সৃষ্টি করেছেন স্বপ্নের ভুবন (পূর্ণতা, পূরবী) আর সুধীন্দ্রনাথে জেগেছে নিখিলনাস্তি, মৃত্যুচেতনা। প্রেমিকার পরিগ্রহণের বাণী যেন বিধাতার স্পর্শমণির মতো ছড়িয়ে পড়েছিল অম্বরে অম্বরে; গতিবাদের তত্ত্বানুযায়ি নবজীবনের বীজ উদগত হয়েছিল, অসীম শূন্যতায়। কবি দেখেছিলেন আদিম অণুর মতো সৃষ্টিরি সানন্দ নৃত্য (অনুষঙ্গ, অর্কেস্ট্রা)। কিন্তু নারীরূপি কঙ্কালের প্রলোভনে (প্রত্যাখ্যান, অর্কেস্ট্রা) বীতশুদ্ধ হওয়ার পর ভেঙে পড়েছে ‘য়িহুদির হিংস্র ভগবানের সিংহাসন‘। ব্যোমের পরিধি ‘পরে নতুন জীবনের বীজ বপনকারি সৃষ্টিধর ঈশ্বর ক্রন্দসীতে এসে পরিণত হন চক্রান্তের উর্ণাজাল বুননকারিতে।
প্রেম অর্কেস্ট্রার প্রধান বিষয়। প্রেমচেতনায় কবিকে উদ্বোধিত করেছে সমসাময়িক subjective and relative reality; ফ্রয়েডিয় তত্ত্বানুযায়ি কবি মুক্তির অন্বেষণ করছেন। বিদেশ ভ্রমণের পর্যায়ে (ফেব্রুয়ারি-ডিসেম্বর ১৯২৯) প্রেমের স্মৃতিতে সুধীন্দ্রনাথের বিদেশিনি নায়িকা বহুচারিণি ও ছলনাময়ি। রবীন্দ্রনাথের লেটিন আমেরিকা ভ্রমণের (১৯২৪) সুখদা, কল্যাণী ও শাশ্বতী থেকে এ নায়িকা বিপরীতধর্মী ।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অঙ্কন করেছেন বোদলেয়ারের পাষাণপ্রতিম, স্তব্দহিম ধবল সুন্দরীকে। সুধীন্দ্রনাথের প্রেমিকা আলেয়ার প্রতিক-তার ডাকে কবির যৌবন পঙ্কের বিপাকে নিমজ্জিত; কবি ক্লান্তিচেতনায় অব্যাহতি চেয়েছেন এ অভিশাপ থেকে। ক্রন্দসীতে এ বোধ, বিস্তৃত অমর পটভুমিতে আরো কালিমালিপ্ত; সেখানে নায়িকা হয়ে উঠেছে পাপ ও মৃত্যু, নিষ্ঠুরতা ও বীভৎসতার প্রতিক। ক্রন্দসীতে প্রেম ও ঈশ্বরবিশ্বাসে নাস্তিচেতনা জাগ্রত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নগরচেতনাতেে এসেছে মৃত্যুবোধ। কলকাতা শহর হয়ে উঠেছে কবির কাছে বোদলেয়ারের প্যারিসের মত। বেশ্যাবৃত্তি, শাঠ্য, প্রতারণা, লাঞ্ছনা ও কৃত্রিমতার প্রতিক। বোদলেয়ারের নারী ‘চুল্লির কয়লায় ফেলা সাপনির মত কাৎরে ওঠে;/কঠিন কর্সেটে বেঁধা তুঙ্গ স্তন দুই হাতে ছেনে’ কথা বলে (পিশাচীর রূপান্তর, ক্লেদজ কুসুম) কবি সুধীন্দ্রনাথও পঙ্কলিপ্সু এই নগর কলকাতার চিত্র এঁকেছেন, যেখানে প্রতিক্ষারত ‘মায়াবিনি’-রা ‘লালসার আহলাদে অবশ‘।
বিংশ শতাব্দির ব্যক্তিমানুষের ট্রাজেডিকে কবি তাঁর প্রকরণের সাহায্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবেগ ও মননের সঙ্গমে যে আঙ্গিকের জন্ম তা স্বাভাবিকভাবেই সাধারণের বাকরীতি থেকে পৃথগধর্মী হয়েছে। যুক্তির পরস্পর্য ও মননের দৃঢ়বদ্ধতা সুরক্ষার জন্য, কবি প্রতিকি শিল্পিদের মত ব্যবহার করেছেন ধ্রুপদিভঙ্গি। গদ্যের পদবিন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে অচলিত, অপ্রচলিত ও নব্য আবিস্কৃত শব্দ। প্রচলিত কাব্যরীতি ও প্রচলিত শব্দে বিংশ শতাব্দিকে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না বলে, কবি নব প্রকরণের আশ্রয় নিয়েছেন। এ পর্বের কবিদের মধ্যে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তেরে সনেট সাফল্য সর্বাগ্রে উল্লেখনীয়; তিরিশের দশকের গোড়ায় শেক্সপিয়র ও মালার্মের অনুবাদসূত্রে এর সূচনা। তারঁ সনেটের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর নাট্যগুণ-শেক্সপিয়র থেকে যা অর্জিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মোহিতলাল মজুমদারের সনেট থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এ সনেটগুলো-নাটকীয় শতাব্দীর জীবনভাষ্য রচনায় অনন্য কবি। এ অনন্যতার প্রধান, প্রথম ও অমর শিল্পী কবি সুধীন্দ্রনাথ।
সনেটে প্রধান বৈশিষ্ট্য অন্ত্যানুপ্রাসের সার্থক প্রয়োগে পরিলক্ষিত। মিলগুলো ভেতরের শক্তিতে প্রাণবান সংঘর্ষ লেগে উঁৎক্ষিপ্ত, স্ফুলিঙ্গময়; অন্যায়/বন্যায়, তলে/বিরলে, বিস্তৃতি/সুকৃতি, যবে/হবে- এর উদাহরণ। এর ফলে শব্দসমূহ প্রচলিত বাচ্যার্থ থেকে মুক্তি পেয়ে ব্যঞ্জনাধর্মী প্রতিকতা লাভ করেছে। সুধীন্দ্রনাথের শব্দের বিকিরণশীলতাকে ফরাসি পদার্থবিদ পিয়ারে কুরির (১৮৫৯-১৯০৬) রেডিয়ামের আবিস্কারের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। কুরির আবিস্কার প্রথমবারের মত দেখানো পরমাণুর অফুরন্ত শক্তিমত্তা; সুধীন্দ্রনাথের আবিস্কার প্রদর্শন করে শব্দের শক্তি।
এভাবেই এ তিন কবি তাঁদের মনন, প্রজ্ঞা, ছন্দময়তা আর কবিত্বে ইউরোপিয় রেনেসার সাহিত্যিক ধারকরূপে পরিচিত art for art sake তথা কলাকৈবল্যবাদি ধারাকে প্রচার করে আধুনিক বাংলা কবিতায় এবং এর অনুসঙ্গ অস্তিত্বে।
৩ পর্বে শেষ হলো।
তারিক লিংকন বলছেনঃ
এভাবেই এ তিন কবি তাঁদের মনন, প্রজ্ঞা, ছন্দময়তা আর কবিত্বে ইউরোপিয় রেনেসার সাহিত্যিক ধারকরূপে পরিচিত art for art sake তথা কলাকৈবল্যবাদি ধারাকে প্রচার করে আধুনিক বাংলা কবিতায় এবং এর অনুসঙ্গ অস্তিত্বে।
সিরিজটি চমৎকার লাগলো। অনেক কিছুই জানতে পারলাম। প্রিয়তে নিলাম।
:-bd :-bd :-bd m/ m/ m/
প্রাগৈতিহাসিক বলছেনঃ
তারিক লিংকনকে ধন্যবাদ
অসীম নন্দন বলছেনঃ zovirax vs. valtrex vs. famvir
পোষ্ট প্রিয়তে নিলাম। এর আগের দু পর্বের লিংক পেলে কৃতার্থ হতাম। :-bd :-bd